সৈয়দ হাবিবুর রহমান ডিউক, শায়েস্তাগঞ্জ : ওদের নিজস্ব কোন ঘর নেই। খড়কুটো আর টিন বা ছনের বেড়া দিয়ে নির্মিত ঘরেই তাদের বেচে থাকার জন্য মাথাগোজার ঠাই। এখানে তাদের ছেলে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা। ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়েদের কান্নার আওয়াজ প্রতিদিনের মত নিয়মিত ঘটনা। এখানে জনসচেতনতার বড়ই অভাব। তবে তাদের রয়েছে কেবলই ভোটার অধিকার, কিন্তু ভোট দিতে পারলে ও তারা নাগরিক নানা সুবিধা থেকে অধিকাংশরাই এখনো উপেক্ষিত। রোদ বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে প্রতিদিন জীবনের সাথে সংগ্রাম করেই গতানুগতিকভাবে চলছিল তাদের জীবন।

এতক্ষণ বলছিলাম, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার নুরপুর ইউনিয়নের সুতাং বাজারের সংলগ্ন আব্দুল্লাহপুর বস্তির মানবেতর জীবন যাপনের নিয়মিত গল্প।

জানা যায়, স্বাধীনতার আগে কয়েকটি পরিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অস্টগ্রাম থেকে এসে সুতাং বাজারের পাশে এসে বসবাস করা শুরু করে। পরবর্তীতে সংগ্রামের পরে আস্তে আস্তে আরো কয়েকজন এখানে জীবন জীবীকার টানে চলে আসেন। ধীরে ধীরে তাদের পরিবার ও মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে। এখানে বর্তমানে প্রায় ২৩ টি পরিবার বসবাস করে আসছে।

এসব পরিবারের বেশিরভাগ পুরুষরাই ধান চালের বস্তা মাথায় করে গাড়িতে তুলে দিয়ে তাদের জীবীকা নির্বাহ করে থাকেন। তবে সম্প্রতি একান্নবর্তী পরিবারের ছেলেরা নানান পেশায় ও জড়িত হয়েছেন। কেউবা চা বিক্রি করেন, কেউবা ঝালমুড়ি বিক্রি করেন, আবার কেউ কেউ প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করেন। নুরপুর ইউনিয়নের সুরাবই গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে ভোটার হলে ও আব্দুল্লাহপুর নামেই তাদেরকে সবাই মুখে মুখে চিনেন। সারাদেশে করোনা ভাইরাস মহামারী আকারে ধারণ করায় চলমাম লকডাউনে এসব পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করে আসছে। সরেজমিনে গিয়ে কথা বললে তারা বিগত দুই মাস ধরে খুবই কস্টে দিনাতিপাত করে আসছেন বলে জানান।

এই পাড়ার আব্দুল কাইয়ুমের স্ত্রী শিরিন আক্তার জানান, আমার ৪ মেয়ে দুই ছেলে।এর মধ্যে এক মেয়ে প্রতিবন্ধী। বিগত কয়েকবছর ধরে তার মেয়ে প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়ে আসছেন। কিন্তু এই লকডাউনে তিনি তার চায়ের দোকান খুলতে পারেন না। শিরিন আক্তার ও তার স্বামীসহ সুতাং বাজারে চা বিক্রি করে জীবীকা নির্বাহ করেন। লকডাউনের কারণে তিনি ছেলে মেয়ে নিয়ে বিপাকে আছেন।

সুফিয়া বেগমের স্বামী নেই, স্বামী না থাকলে ও বিধবা ভাতা পাননা। তার ৩ ছেলে ও এক মেয়ে আছে উনার ছেলে আনোয়ার আগে কাজ করে সংসার চালাত কিন্তু করোনায় সে বেকার হয়ে পড়েছে।

শরিফা বেগম জানান, তার দুই ছেলে দুই মেয়ে আছে। ছোট ছেলে সুজন আগে একটা হোটেলে কাজ করত। কিন্তু লকডাউনের কারণে হোটেলে বেচাকেনা না থাকায় সে ও কাজে যায়না, তাদের ও অনেক কস্টে অনাহারে দিন যাচ্ছে।
আরেকজন বয়স্ক মহিলা জেসমিন বেগম আক্ষেপ করে বলেন, গত ৪ বছর ধরে আমার একটি মেয়ে প্রতিবন্ধী, কিন্তু টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারিনা। যেখানে ঠিকমতো তিন বেলা খাবারই যোগাড় করতে পারিনা, সেখানে চিকিৎসা তো কেবলই বিলাসিতা। মেয়েটা যদি প্রতিবন্ধী ভাতা পেত তা ও কিছুটা উপকার হত।

পুরো আব্দুল্লাপুর পাড়া জুড়েই ঠিক যেন একটি পরিবার থেকে আরেকটি পরিবারের কস্টের ধরনটাই আলাদা।
এ গ্রামের প্রতিটি পরিবারই যেন অন্নবস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। খোজ নিয়ে জানা যায়, এ পাড়ার বেশ কয়েকজন দশ টাকা দরের চাল পেতেন। কিন্তু অযাচিত কারণে এ ইউনিয়নে চাল বিতরণ বন্ধ থাকায় তারা এখন এ সুবিধা থেকে ও বঞ্চিত রয়েছেন।

সামান্য জায়গায় টিনের বেড়ার ঘরে থাকলে ও তাদেরকে প্রতি মাসে মাসে ৪০০ টাকা করে ঘরভাড়া ও দিতে হয়, সেই সাথে দিতে হয় বিদ্যুৎ বিল। এই মহামারীর সময়ে কোন মাসের ঘরভাড়া মওকুফ করেনি মালিকপক্ষ।

আব্দুল্লাহপুরের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ায় আগ্রহ নেই, বয়সে একটু ফুরসৎ হলেই কাজে টেলে দেন অভিবাবকরা। তাই এসব মানুষের ভাগ্য ও পাল্টানোর সুযোগ আসেনা। তবে প্রতিবারই নির্বাচন এলে মিটিং মিছিল, পোস্টার লাগানোর কাজের জন্য ওদের কদর বাড়ে।

সুতাং বাজারের ধান ব্যবসায়ী এম এ মামুন আহমেদ জানান, লকডাউনের কারণে তারা অনেক কস্টে আছে। আর কয়েকমাস যাবত ধানের আমদানি রপ্তানি কম থাকায় আব্দুল্লাহপুরের যারা বস্তা টানার কাজ করতেন, তাদের এখন কাজ নেই। তাই হয়ত তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমি তাদেরকে সরকারিভাবে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

এ ব্যাপারে নুরপুর ইউনিয়নের সুরাবই গ্রামের ইউপি সদস্য, আবুবকর ছিদ্দিক জানান,আমি চেষ্টা করি তাদেরকে সহায়তা করার জন্য, রোযার ঈদে তাদেরকে সহায়তা করেছি। কিন্তু আমার বরাদ্দ সীমিত থাকায় এবার ঈদুল আজহাতে তাদেরকে সহায়তা করতে পারিনি। সামনে বরাদ্দ আসলে তাদেরকে সহায়তা করা হবে।

এ বিষয়ে নুরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মুখলিছ মিয়া জানান, আমি প্রতিবারই তাদেরকে সহায়তা করে আসছি। ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দ সারা ইউনিয়নেই বন্টন করতে হয়, এবার তারা হয়ত বাদ পড়েছে, পরবর্তীতে তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহায়তা করা হবে।

এ বিষয়ে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিনহাজুল ইসলাম জানান, ঈদের আগ পর্যন্ত নুরপুর ইউনিয়নে নগদ অর্থ সহ প্রচুর পরিমান চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আমি খোজ নিয়ে বিষয়টি দেখছি, খুব শীঘ্রই তাদেরকে সহায়তা করা হবে।