মোঃ আবদুল হক রেনু/শাহ্ মোস্তফা কামাল, শায়েস্তাগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি ॥ শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশনের একমাত্র শাখা রেলপথ চুনারুঘাট উপজেলার সীমান্ত এলাকার বাল্লা থেকে হবিগঞ্জ বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৯২৮ সালে বৃটিশ শাসনামলে প্রায় ৪৫ কি.মি. দীর্ঘ এ রেললাইনটি স্থাপিত হয়। সেই শুরু থেকে চলা এই রেলপথ একসময় ওই এলাকার জনসাধারণের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। তাই সে সময়ে এটি খুবই জনপ্রিয় যাতায়াত ব্যবস্থার স্বীকৃতি পেয়েছিল এবং নিয়মিত যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করা হতো ট্রেনে।
কারণ, তখনকার সময়ে বাল্লা থেকে হবিগঞ্জ পর্যন্ত যাতায়াতের সুগম্য কোন সড়কপথ ছিলনা। হবিগঞ্জ জেলাধীন সীমান্ত এলাকার সকল শ্রেণীর মানুষের জেলা সদরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র যোগসূত্র ছিল এ ট্রেন। শায়েস্তাগঞ্জ জংশনের এই শাখা রেলপথ বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি অন্যতম আয়ের উৎস হিসেবে গন্য হতো এবং আয়ও হতো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। ২০০৩ সালে হঠাৎ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে ব্যয় শঙ্কোচনের অজুহাতে এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের অনেক শাখা রেলপথ বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই অংশ হিসেবে শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশনের এই আলোচ্য রেলপথও বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ রেলওয়ের এই সিদ্ধান্তে এ দেশে শতশত কি.মি. রেলপথ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে লুটপাট হতে থাকে হাজার কোটি টাকার রেলসম্পদ। অন্যদিকে এ সুযোগে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের দখলে চলে যায় রেলওয়ের মহামূল্যবান শত শত একর ভূ-সম্পত্তি।
রেল কর্তৃপক্ষ স্ব-উদ্যোগে মাঝে মাঝে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে বেদখল হওয়া ভূমির কিয়দংশ উদ্ধার করলেও তা আবার অদৃশ্য প্রভাব প্রয়োগের মাধ্যমে রাতারাতি বেদখল হয়ে যায়। ইতিমধ্যে লুটপাট হয়ে যাওয়া রেলের যন্ত্রপাতিসহ অস্থাবর সম্পদ আর কখনোই ফিরে পাওয়া যাবেনা। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উক্ত সম্পদ রক্ষায় ও নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য কোন উদ্যোগ বা কোন ভুমিকাও পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। ২০০৫ সালে সরকার কর্তৃক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যে হবিগঞ্জ বাজার থেকে শায়েস্তাগঞ্জ জংশন পর্যন্ত প্রায় ১৫ কি.মি. রেলপথ অপসারণ করা হয়। এই রেলপথকে সড়কপথে রূপান্তর প্রক্রিয়ার সুযোগে কতিপয় তষ্কর প্রকৃতির লোকজন স্টেশন ঘরের মূল্যবান যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, দরজা, জানালা ইত্যাদি আত্মসাৎ করে নিয়ে গেছে। এখন ইট সিমেন্টের তৈরী ঠুনকো কাঠামোগুলো শুধু দাঁড়িয়ে আছে। এই পরিত্যক্ত রেলপথের অস্থাবর সম্পত্তি বলতে এখন আর অবশিষ্ট কিছুই নাই, উপরন্তু এখন চলছে ভূ-সম্পত্তি দখলের মহোৎসব। একশ্রেণির প্রভাবশালী এসব ভূমি দখলে রেখে আধূনিক বাণিজ্যিক ইমারত নির্মাণ করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘেœ। কেউ কেউ আবার রেলওয়ের ভূমি দখলে রেখে চাষাবাদ করছেন নানান জাতের নানান বর্ণের ফসল।
এদিকে শায়েস্তগঞ্জ থেকে বাল্লা পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ কি.মি. রেলপথের ৭টি স্টেশনের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। স্টেশন বলতে আর অবশিষ্ট তেমন কোনো কিছু নাই। শুধু জরাজীর্ণ কাঠামোগুলো দাঁড়িয়ে এর অস্তিত্ব মনে করিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিবর্গ ও কতিপয় জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় একটি মহল প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে রাতের আঁধারে মালবাহী যানবাহনে করে রেলপথের এসব সম্পদ অদৃশ্য করে দিয়েছে চিরতরে। সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শায়েস্তাগঞ্জ-বাল্লা রেলপথের রেল লাইনের পাত, কাঠের স্লিপার, পাথর, সিগন্যাল-পোস্ট, সিগন্যাল-তার, নাট-বল্টু ইত্যাদি অতি দক্ষতার সহিত উৎপাটন করে লুটপাট করা হয়েছে। স্থানে স্থানে এমন চাতুরতার সহিত এই চৌর্যকর্ম সম্পাদন করা হয়েছে যে, উক্ত স্থানে রেল লাইনের কোন চিহ্ন খোঁজেই পাওয়া যায়না। দেখলে মনে হয় এটা কোন গ্রাম্য মনোরম মেঠোপথ। আলাপ কালে শায়েস্তাগঞ্জ জিআরপি পুলিশ কর্মকর্তা এস আই সাহিদুল ইসলাম বলেন, শায়েস্তাগঞ্জ-বাল্লা রেলপথের সরকারি সম্পদ চুরি রোধে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছি। ওই সময় শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, এ রেলপথ পূনরায় চালু করার প্রত্যয়ে কাজ চলছে। এর অংশ হিসেবে অচিরেই এই রেলপথ সংস্কার কাজ শুরু হবে।
অত্র অঞ্চলের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত, শায়েস্তাগঞ্জ থেকে সিমান্ত এলাকা বাল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত দীর্ঘ রেলপথ একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের নামের সহিত সংযুক্ত জংশন শব্দটি ও আর থাকবেনা। জংশন হিসেবে শায়েস্তাগঞ্জের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, গুরুত্ব ও মর্যাদা হারিয়ে যাবে চিরতরে। শায়েস্তাগঞ্জ জংশনের গৌরব, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অক্ষুন্ন রাখার জন্য এ রেলপথটি অতি দ্রুত পুনরায় সচল করা আবশ্যক।এটি শায়েস্তাগঞ্জ, চুনারুঘাট, বাল্লা ও হবিগঞ্জ সদর এলাকার লাখো মানুষের প্রাণের দাবী।